
মানবাধিকার লঙ্ঘনের হটস্পট এখন বাংলাদেশ
গত ২৮ অক্টোবর আমেরিকান সিনেটের ১০ সদস্য র্যাবে থাকা শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির অনুরোধ জানিয়ে তাদের সরকারকে চিঠি দেয়ার পর বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্য। এছাড়া গত ১৫ নভেম্বর অস্ট্রেলিয়ান পার্লামেন্টে একজন সিনেটর বাংলাদেশকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের হটস্পট বলে উল্লেখ করেন। এজন্য ব্যবস্থা গ্রহন করতে দেশটির সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। গত এক মাসের ব্যবধানে এই ৩টি দেশ উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নাজুক বলে উল্লেখ করেছে। এর আরো আগে খোদ আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদনেও বাংলাদেশর মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানানো হয়েছিল। আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদনেও উল্লেখ করা হয়েছিল বিচারবহির্ভুত হত্যাকান্ড এবং ভিন্নমতের গণমাধ্যমের টুটি চেপে ধরার বিষয়টি।
বাংলাদেশে বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ড, নারীর প্রতি অব্যাহত সহিংসতা, আইন শৃঙ্খলাবাহিনী দ্বারা ভিন্নমতের লোকদের গুম করা, ভিন্নমতের গণমাধ্যম জোর করে বন্ধ করে দেয়া ও ডিজিটাল সিকিউিরিটি অ্যাক্টের নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষের কথা বলার অধিকার হরণের ঘটনা দুনিয়া জুড়ে এখন আলোচিত বিষয়। আমেরিকান সিনেট, অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্ট ও যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দফতর এনিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দেয়ার ঘটনা থেকেই প্রমানিত বাংলাদেশ এখন মানবাধিকার লঙ্ঘনের হটস্পট।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র তুলে ধরে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দফতর থেকে ইস্যু করা বিবৃতিতে নির্বাচনে ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন ও বিরোধী প্রার্থীদের ওপর আক্রমণের বিষয়টিও উঠে এসেছে। বিবৃতিতে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ১৫৮ জনের বিচারবহির্ভূত হত্যার পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলা হয়, প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি দীর্ঘ দিন ধরেই নাজুক অবস্থায় রয়েছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্রমেই সঙ্কুচিত হচ্ছে বলেও উল্ল্যেখ করা হয় এতে।
বৃটিশ পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদনে মানবাধিকার পরিস্থিতি নাজুক এমন ৩০টি দেশের সাথে বাংলাদেশের চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়। এতে বলা হয়, ৩০টি দেশের মানবাধিকবর পরিস্থিতি উদ্বেগজনক।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, নির্বাচন নিয়ে সরকার দেশে যে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা এখন সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গত ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিরোধীদলীয় এক প্রার্থীর ওপর হামলা এবং ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শনের ব্যাপক অভিযোগ ছিল। নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করায় সরকার বাংলাদেশে যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য কূটনৈতিক মিশনের সমালোচনা করেছে।
চলতি বছরে ৩৮জন সাংবাদিকসহ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে চার শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতারের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলা হয় ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ কমে আসছে।
উল্লেখ্য, ব্রিটেনের পররাষ্ট্র, কমনওয়েলথ ও উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রণালয় গত জুলাই মাসেও ২০১৯ সালের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক প্রতিবেদন প্রকাশ করে৷ প্রতিবেদনে বাংলাদেশসহ ৩০টি দেশকে চিহ্নিত করে তাদের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানায় দেশটি৷ সেই পর্যালোচনা অব্যাহত রেখে গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসের চিত্র তুলে ধরা হয় ২০ নভেম্বরের প্রতিবেদনে৷
মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আমেরিকা, যুক্তরাজ্য এবং অস্ট্রেলিয়ার উদ্বেগ প্রকাশকে থোরাই কেয়ার করছে সরকার। এর মধ্যেই মানবাধিকার সংগঠন গুলোর প্রকাশিত তথ্যে উঠে এসেছে গত জুলাই-সেপ্টেম্বর, তিন মাসে ৫৫ জন ব্যক্তিকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৩২ জন ব্যক্তি পুলিশ, ১৩ জন ব্যক্তি র্যাব, ৯ জন ব্যক্তি বিজিবি ও ১ জন ব্যক্তি গোয়েন্দা পুলিশের হাতে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এতে দেখা যায়, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে মোট ২১৩ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
যুক্তরাজ্যের প্রতিবেদন প্রকাশের মাঝেই বিরোধী দলের ৫ জন নেতা হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে বের হয়ে যাওয়ার সময় আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত ১৯ নভেম্বর হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে বের হয়ে যাওয়ার সময় সাদা পোশাকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ঢাকা তুরাগ থানার ৫ নেতাকর্মীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ করেছেন বিএনপি’র মহাসচিব। এক সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ করে তাদের অবিলম্বে ফিরিয়ে দেয়ার আহ্বানও জানিয়েছিলেন।